বাংলা রচনা
সমগ্র
সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার
(সংকেত: ভূমিকা; বাংলা ভাষা; আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি; নিজভূমে পরবাসী; গুরুত্ব ও প্রয়োজনীতা; সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন সংক্রান্ত আইন; সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারে সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; কতিপয় অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত; বুদ্ধিজীবীদের মতামত ও সুপারিশ উপসংহার।)ভূমিকা: কবি রামনিধিগুপ্ত বলেছেন-
বিনে স্বদেশী ভাষা পূরে কি আশা”।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: সমগ্র বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষা এখন সমাদৃত। এ ভাষার মর্যাদা আজ পৃথিবীজুড়ে প্রতিষ্ঠিত। জাতিংসঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কোর ঘোষণা অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি তথা শহিদ দিবস “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’র মর্যাদায় অভিষিক্ত। বাংলা ভাষা ও ভাষা শহিদের সম্মানে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর সংস্থাটি এ ঘোষণা দেয়।
নিজভূমে পরবাসী: পৃথিবীজুড়ে সমাদৃত ও সম্মানিত হলেও অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় খোদ বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে বাংলা ভাষা যেন অবহেলিত। অযত্ন অনাদরে পড়ে আছে দুঃখিনী বাংলা। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ও ব্যবহারে যে স্বপ্ন নিয়ে রক্ত দিয়েছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা, তাঁদের সে স্বপ্ন যেন আজ ক্রমশ ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। ব্যাক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আইন-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্রই উপেক্ষিত বাংলা। শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষত উচ্চ শিক্ষায় বাংলা ব্যবহার নেই বললেই চলে। অথচ ভাষাগত দিক থেকে বাংলা যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী। তথাপি বাংলা যেন নিজভূমে পরবাসী। কবি মাইকেল মুধুসূদন দত্তের ভাষায়-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি।
সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনসংক্রান্ত আইন: ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা পায় বাংলা। সংবিধানের ৩য় অনুচ্ছেদে লেখা হয়, “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা” সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিলেও সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। ফলে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ “বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭’ প্রণয়ন করা হয়। ওই আইনের ৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে ‘এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিত হইবে। এই ধারা মোতাবেক কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’ এই আইনটিও ব্যর্থ হলে ১৯৯৮ সালের শেষদিকে ‘বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ’ গঠন করা হয়। এর কর্মপরিধির মধ্যে অন্যতম ছিল বৃটিশ আমল থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও আদালতের প্রযোজ্য ইংরেজিতে প্রণীত আইন বাংলা ভাষায় রূপান্তর। এ কার্যক্রমটি কিছুদিন জোরেশারে চললেও এক সময় তা গতি হারিয়ে ফেলে। আজ এর অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে।
সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারে সমস্যা: ব্যক্তি পর্যায়ে থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে এ ভাষা ব্যবহারযোগ্য। ধ্বনিতাত্ত্বিক দৈন্য কিংবা প্রয়োগিক কোনো সমস্যাও এ ভাষার নেই। কতিপয় সমস্যা লক্ষ্য করা যায়, যা সমাধানযোগ্য যেমন-
কতিপয় অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত: আইন-আদালত সংক্রান্ত পরিভাষার জটিলতা সর্বস্তরে মাতৃভাষার ব্যবহারে ক্ষেত্রে প্রধানতম অন্তরায় বলে মনে করা হয়। বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিষয়ক পরিভাষার অভাবকে ও এক্ষেত্রে দায়ী করা হয়। অথচ চীন-জাপান তাদের চিত্রলিপির দুর্ভেদ্য ভাষা দিয়েই উচ্চশিক্ষায় জায়গা করে নিয়েছে। চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এমনকি প্রতিবেশী নেপালেও তাদের নিজস্ব ভাষায় আদালত চলছে। খোদ বাংলাদেশেও কতিপয় ভাষাপ্রেমিক বিদ্বান বিচারপতি আদালতে পুরোপুরি বাংলা ভাষা ব্যবহারের অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মহান ভাষা দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় রায় প্রদান করেন বিচারপতি এবাদুল হক। এরপর বিচারপতি আব্দুস সালাম ও বিচারপতি খায়রুল হক বাংলা ভাষায় রায় প্রদান করে উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার মর্যাদাকে সু-উচ্চে তুলে ধরেন। উচ্চ আদালতে সর্বাধিক বাংলা ভাষায় রায় দিয়ে অমর হয়ে আছেন চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান শ্রদ্ধেয় বিচারপতি আব্দুস সালাম মামুন। এছাড়া বিচারপতি মোহাম্মদ হামিদুল হক, বিচারপতি আব্দুল আওয়াল, বিচারপতি মোহাম্মদ আবু তারিক, বিচারপতি এস. এম জিয়াউল করিম প্রমুখের নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বুদ্ধিজীবীদের মতামত ও সুপারিশ: সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে সমস্যা ও তা থেকে উত্তরণের জন্য ভাষাসৈনিকসহ দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীগণ দিকনির্দেশনামূলক সুপারিশ ও মতামত প্রদান করেছেন। নিম্নে কতিপয় সুপারিশ ও মতামত তুলে ধরা হল। বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন না হবার পেছনে রাজনৈতিক উদাসীনতা এবং সরকারি উদ্যোগহীনতাকেই দায়ী মনে কনেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। স্কুল-মাদ্রাসায় ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাব্যবস্থার এই বিভাজনও তাঁর মতে সমভাবে দায়ী। এ থেকে উত্তরণের জন্য তিনি বলেন- “সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রচলন করতে হবে। একই দেশে তিন ধরণের শিক্ষা পদ্ধতি নয়, ধনী-দরিদ্র সবার জন্য একধরণের শিক্ষা চালু করতে হবে। পাশাপাশি বাংলা ভাষায় প্রচুর সাহিত্য লেখা ও গবেষণা করতে হবে যাতে ভাষা আরো সমৃদ্ধ হয়।
মাতৃভাষা রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে।
No comments:
Post a Comment